ফরিদপুর জেলার সোহানপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান পিরু মোল্লা। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে চালিয়েছেন লেখাপড়া। এখন তিনি বিসিএস ক্যাডার। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তাঁর সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে ডেকে কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ক্যাডার হওয়ার পেছনের গল্প ও সংগ্রামী জীবনের কথা শুনেছেন আব্দুন নুর নাহিদ
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে এখন বিসিএস ক্যাডার।
বিসিএসের শুরুটা এবং প্রথম আগ্রহ তৈরি হলো কিভাবে?
স্কুলে থাকাকালে শিক্ষকরা বলতেন দেশের সব মেধাবীর মধ্য থেকে বাছাই করে বিসিএসে প্রতিবছর লোক নেয়, তারা সবাই মেধাসম্পন্ন ও স্মার্ট। ভালো বেতনসহ সম্মানজনক চাকরির স্বপ্ন থাকে অনেকের। তখন থেকেই মূলত আগ্রহ তৈরি হয় বিসিএসের ব্যাপারে।
কতবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন? ভাইভায় কতবার ডাক পেয়েছেন?
✅দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে এখন বিসিএস ক্যাডারসাতবার বিসিএস দিয়েছি।
✅এর মধ্যে ভাইভায় ডাক পেয়েছি দুইবার।
✅ছয়বার ব্যর্থ হাওয়ার পর সপ্তমবারের বেলায় ৪০তম বিসিএসে যোগদান করি।
✅ভাইভা বোর্ডে ৩৫ মিনিটের মতো প্রশ্ন করা হয়েছিল।
সপ্তমবার ক্যাডার হওয়ার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী ছিলেন?
৪০তম বিসিএসের পর সরকারি চাকরির বয়স শেষ হবে।
তাই মনে টেনশন কাজ করছিল। ভাইভা বোর্ডের সিরিয়ালে আমিই ছিলাম প্রথম। ভাইভায় তুলনামূলক বেশিক্ষণ প্রশ্ন করা হয়েছিল। আর সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে পেরেছি।
এ কারণে আশাবাদী ছিলাম। ভাইভা দিয়ে যখন চলে আসি, তখন একজন এক্সটার্নাল বললেন, শুভ কামনা রইল। তখন আরো আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। মন বলছিল, যেকোনো একটা ক্যাডার পাবই!
ছোটবেলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন পর্যন্ত আপনাকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে? সংক্ষেপে বলুন।
আমার বড় ভাই ছিলেন শিক্ষক।
তাই স্কুলে পড়ার সময় কোনো প্রাইভেট পড়তে হয়নি। তবে জীবনে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। পড়াশোনা চলাকালে আমাকে পরিবারের সঙ্গে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতে হতো। অনেক কষ্ট করেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। কলেজে পড়ার সময় স্যাররা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। এইচএসসি পাসের পর ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। টাকা বাকি রাখায় রুম থেকে বের করে দেয়, তখন কোচিংয়ে পরীক্ষা চলছিল। অপমানে বাড়ি চলে আসি। রাগের মাথায় ভাবতাম, আর পড়ালেখাই করব না। এরপর আর কোচিংও করা হলো না। প্রস্তুতি না থাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরম তোলা হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় ৬০ টাকায় ফরম তুলে পরীক্ষা দিয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই।
পরিবার থেকে আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারায় দিনে তিন বেলা খাবার জোটানোই আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। পরে টিউশনি পাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।
এ পর্যন্ত কতগুলো চাকরির বাছাই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন? এর মধ্যে কতগুলোতে উত্তীর্ণ হয়েছেন?
১০টি চাকরির বাছাই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চারটিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক এবং সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহকারী প্রগ্রামার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম।
অনার্স-মাস্টার্স কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে? ফলাফল কেমন ছিল? এসএসসি-এইচএসসিতে ফলাফল কী?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। অনার্সে ছিল ৩.০৭ এবং মাস্টার্সে ২.৮৫। আনছার উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসিতে ছিল ৪.৪৪ এবং ফরিদপুর সরকারি ইয়াসিন কলেজে এইচএসসিতে ছিল ৪.৭০।
বিসিএসের প্রস্তুতি অনার্সের কোন বর্ষ থেকে শুরু করেছেন? আপনার প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত বলুন। কোন কোন বই পড়েছেন? দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি কেমন ছিল? প্রিলি রিটেন ও ভাইভার আগে কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন?
অনার্স শেষ করার পর বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছি। ৩৩তম বিসিএসে আমার বন্ধুদের ক্যাডার হওয়া দেখে মূলত বিসিএসের প্রেমে পড়ে যাই। তখন থেকেই পড়াশোনা শুরু করি। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। যেকোনো ধরনের বই পড়াসহ সমসাময়িক ঘটনাগুলো জানার আগ্রহ ছিল বেশি। কয়েকটি বিসিএসে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় টিকেও শেষ পর্যন্ত ক্যাডার হতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে সরকারি ইয়াসিন কলেজের প্রভাষক শাজাহান স্যারের পরামর্শ ও বিভিন্ন ধরনের দিকনির্দেশনায় বিসিএসের পড়াশোনা শুরু করি।
বিসিএসের প্রফেসরসের পুরো সেট পড়েছিলাম। আমার সফলতা আসতে দেরি হলেও লেগে ছিলাম। প্রিলি-রিটেন পরীক্ষায় ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি ভাইভার আগে বিষয়ভিত্তিক একাডেমিক পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সমসাময়িক বিষয়ের ঘটনাগুলো জানতে হবে।
প্রথমবার যারা বিসিএস দেবে কিংবা এর আগে বিসিএস দিয়েও সফল হয়নি, তাদের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
অনার্স পড়ার সময় নিজ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ ভাইভা বোর্ডে বিষয়ের দক্ষতা না থাকলে নেগেটিভ মার্কিং হয়। শেষ বর্ষে এসে বিসিএসের পড়াশোনা শুরু করতে হতে পারে। ইংরেজি ও গণিতের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত চর্চা করতে হবে। এতে ভাইভা বোর্ডে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। দেশ-বিদেশের সমসাময়িক ঘটনাগুলো জানতে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতে হবে।
যারা বিসিএস দিয়ে এখনো সফল হয়নি, তাদের এককথায় বলব, হতাশ না হয়ে শেষ সুযোগটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে লেগে থাকা উচিত। যেমন—আমি ৩৩তম বিসিএস থেকে চেষ্টা করে ৪০তম বিসিএসে এসে ক্যাডার হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমার সংগ্রামী ইতিহাসটা সহকর্মীদের সবাই জানত। সবাই আমার নাম সুপারিশ করে। বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চারজনের নাম আসে। পরে আমাকেই প্রথমে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়। আমার এই বক্তব্যের ভিডিওটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
© সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে আজকের প্রকাশিত দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায়।