শাহিন রেজা :
১২ বছর ধরে বাংলাদেশের চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন চলছে। গত সপ্তাহে সচিবালয়ের সামনে বয়স বৃদ্ধিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতা থাকলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও আমলাদের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাঁরা এখন পুরোদমে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এখন সবার প্রত্যাশা, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়তে কাজ করা বর্তমান সরকার এই যৌক্তিক দাবি মেনে নেবে।
১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকার বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে। পরবর্তীতে আর বয়স বৃদ্ধি করা হয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিনের এই আন্দোলনের যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যখন ২৭ বছর থেকে বয়স বাড়িয়ে ৩০ করা হয়, তখন গড় আয়ু ৬০ বছরের কম ছিল। কিন্তু এখন গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের পরবর্তী দুই থেকে তিন বছর করোনার কারণে চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুবই কম ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে গেলে প্রতি সপ্তাহে একই সময় অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে একধরনের বিপাকের মধ্যে পড়তে হয় চাকরিপ্রত্যাশীদের। আবার সেশনজট থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে পড়ালেখা শেষ হচ্ছে না। অন্যদিকে, চাকরির প্রস্তুতি নিতেও একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে ফলে ৩০ বছর থেকে ৩৫ বছর বা চাকরিতে কোনো বয়স না রাখার পক্ষে অনেকে। পৃথিবীর ১৬০টিরও বেশি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সের সীমা বাংলাদেশের থেকে বেশি। কোনো কোনো দেশে বয়স সীমা নেই। ফলে সারা দুনিয়ায় সঙ্গে মিল রেখে চলতে আমাদেরও যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিগত সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বয়স ৩৫ করার কথা থাকলেও তারা এই পথে হাঁটেনি। সুশীল সমাজ বা শিক্ষাবীদদের কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৩৫ বছরের পক্ষে ছিলেন না। তাদের যুক্তি ছিল, বয়স বৃদ্ধি করলে বেকারত্ব বাড়বে। কিন্তু বেকারত্ব কমিয়ে সমস্যা সমাধানে তাদের সদিচ্ছার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
প্রতিনিয়ত দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে বেকার রেখে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হবে। ফলে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব কমাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাছে মনোযোগ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। প্রথমত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মমুখী করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার দিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত তিনটি খাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কৃষি, পোশাক ও রেমিট্যান্স। বিদেশে শুধু শ্রমিক না পাঠিয়ে শিক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে প্রতিটি উপজেলা বা জেলা শহরে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে। পোশাকশিল্প কলকারখানা ঢাকা–গাজীপুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মাণ করতে হবে। এতে ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে, অন্যদিকে মানুষ নিজ এলাকায় থেকে কর্মসংস্থান করতে পারবে। শিক্ষিত তরুণদের কাছে সরকারি চাকরি সোনার হরিণ। কেনো সোনার হরিণ এই উত্তর খুঁজে বেসরকারি চাকরি প্রতি আকৃষ্ট করতে উদ্যোগী হতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলে ছোট বড় শিল্প কলকারখানা তৈরি করে মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করা যায়। পরিকল্পনা এমন ভাবে সাজাতে হবে যাকে বেকারত্ব নামক অভিশাপ দেশ থেকে চিরবিদায় নেই।
সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত ১৯ লাখ ১৫১টি পদের মধ্যে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি পদ শূন্য রয়েছে। ফলে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নজর দিতে হবে আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে। এ দেশের ছাত্রজনতা একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও ২৪ এর ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য। বয়স বৃদ্ধি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বয়স না রাখা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মূল যাত্রা শুরু হোক। এ ছাড়া কাজ করতে হবে বেতন ও আন্তক্যাডার বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সুখী–সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সকলের প্রচেষ্টা, সময়োপযোগী সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও দেশপ্রেম এখন মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: মো. শাহিন রেজা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
** অন্যগণমাধ্যমের খবর : লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে প্রকাশিত ও প্রচারিত ।